বছর দুয়েক আগের ঘটনা। আমরা জেরুজালেমের বেশ কিছু আরকিওলজিকাল সাইট ঘুরে দেখেছি। সেখানেই জানতে পারি প্রভু যিশুর এক শিষ্যার কথা। মেরি ম্যাগডালেন। এই নাম ড্যান ব্রাউনের দা ভিঞ্চি কোডের দৌলতে যা জেনেছিলাম, আমার দৌড় ছিল ঠিক ততটাই। অথচ সেখানে লোকাল গাইড আমাদের এক এমন গল্প শোনল যে সত্যি-মিথ্যের হিসাবে পালটে দেয়। আমরা চলেছিলাম ‘তেল মেদিগো’ শহরের দিকে।
আমাদের স্থানীয় গাইডকে সঙ্গে নিয়ে জেরুজালেম থেকে বের হয়েছি আমরা। সঙ্গে অবশ্যই ভাড়া করা গাড়ি। গাইডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেরুজালেম থেকে ‘তেল মেদিগো’ যাবার সুবিধাজনক কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পাওয়া একটু মুশকিল। কারণ খুব বেশি লোক ইজরায়েলের সীমান্তবর্তী ওই গ্রামে যায় না। জনবসতি প্রায় নেই বললেই চলে। জেরুজালেম থেকে প্রথমে আমাদের যেতে হবে ‘হাইফা’ নামের জায়গাতে, গাড়িতে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। দীর্ঘ রাস্তার ক্লান্তি কাটাতেই কথায়কথায় সে শুরু করে তার গল্প।
.
“সময়টা ৫৯০ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে, অর্থাৎ যীশুর মৃত্যুর প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পর। খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার এবং প্রসার এই পাঁচটা শতকে ইউরোপ ছাড়িয়ে অন্যান্য মহাদেশগুলিকেও স্পর্শ করেছে। খ্রিস্টান ধর্মের প্রাণকেন্দ্র ইতিমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে রোমে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে চার্চ, আর তার প্রধান হলেন পোপ। খ্রিস্টান ধর্মের সর্বময় কর্তা তিনি। সেই সময়ে রোমের পোপ প্রথম ‘গ্রেগরি’। ৫৯১ খ্রিস্টাব্দের এক ‘ইস্টার’এর সকালে তিনি সারা পৃথিবীর খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্যে ইস্টার সারমন করলেন। অন্যান্য অনেক তথ্যের সঙ্গে তিনি এমন এক তথ্য সকলের উদ্দেশ্যে পরিবেশন করলেন যার ফলস্বরূপ পরবর্তী দেড়হাজার বছরের জন্যে কলঙ্কিত হয়ে রইলেন এক নারী, যাকে খ্রিস্টান ধর্মের নাভিমূল বলা চলে। সেই নারী আর কেউ নন, তিনি হলেন যীশুর একনিষ্ঠ অনুগামী সেন্ট মেরী ম্যাগডালেন।
নিজের বক্তৃতায় সেদিন পোপ প্রথম ‘গ্রেগরি’ বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট থেকে একটি সূত্র উদ্ধৃত করে জানালেন, মেরী ম্যাগডালেন আসলে ছিলেন একজন পতিতা অর্থাৎ ‘প্রস্টিটিউট’।
.
“১৯৮২ সাল নাগাদ মেরী ম্যাগডালেনকে “সেন্ট” বলে স্বীকার করে নিল রোমান ক্যাথেলিক এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ। ২০১৬ সালে মেরী ম্যাগডালেন পেলেন দীর্ঘ দু-হাজার বছরে অপ্রাপ্ত তাঁর সর্বচ্চ স্বীকৃতি। পোপ “ফ্র্যান্সিস” তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দিলেন। ২০১৬ সালের ২২শে জুলাই’এর ‘ইস্টার ফিস্ট’এ তিনি ঘোষণা করলেন, মেরী ম্যাগডালেন ছিলেন “অ্যাপস্বল অফ অল দ্য অ্যাপস্বলস”। অর্থাৎ খ্রিস্টানিটির সমস্ত শিক্ষকদের শিক্ষা প্রদান করেছিলেন তিনি।
“এরপর সমস্ত প্রটেস্টান্ট চার্চ মেরীকে “হিরোইন অফ দ্য ফেইথ” আখ্যা দিল। এত সবের পরও কিন্তু সাধারণ খ্রিস্টানদের মনে মেরী ম্যাগডালেন আজও সর্বচ্চ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েই রয়েছেন। হয়তো দেড়হাজার বছরের কলঙ্ক এত কম সময়ে মুছে যায় না বলেই। তবে আজও কিন্তু খ্রিস্টান চার্চ স্বীকার করেনি যে মেরী ম্যাগডালেনই প্রকৃতপক্ষে ‘খ্রিস্টানিটি’র স্থপতি ছিলেন। তিনি যদি রেজারেকশন অর্থাৎ পুনর্জন্মের পর যীশুকে না দেখতে পেতেন তবে হয়তো খ্রিস্টানিটির জন্মই হত না।”
এই শেষ অংশটা আমায় যেন পেয়ে বসল। মেরি ম্যাগডেলান যদি খ্রিস্টান ধর্মের প্রকৃত স্থপতি হন, তাহলে সেখানে প্রভু যিশুর ভূমিকা কি?
.
.
মূল রচনা- বিশ্বজিৎ সাহা
কণ্ঠ- শঙ্খ বিশ্বাস
স্ক্রিপ্ট- কৌশিক রায়
সাউন্ড ডিজাইন- শঙ্খ বিশ্বাস