এক সময়ের সমৃদ্ধ নগরী ছিল কলকাতা। এই নগরের উপর দিয়েই বাণিজ্যে গিয়েছিলেন চাঁদ সওদাগর। তারপরে এক প্রবল জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যায় এ সমৃদ্ধ নগরী। সত্যি নাকি মিথ? জানব আজকের পর্বে।
‘ইয়ে, মানে, বলছিলাম কী, কাল তো কলকাতার নামকরণ নিয়ে অনেক কিছু বললে, তো তার সঙ্গে এক্সট্রা আরও কিছু যদি—’
‘আসলে কাল তোমার ওই বল্লাল সেন, কালীঘাট, এসব শুনে টিকি খাড়া হয়ে গিয়েছে। তাই ভাবছিলুম, কলকাতা কতটা পুরোনো, ইত্যাদি যদি জানতে পারতাম…’
‘বুঝেছি। শোন তবে!’ বলে গুছিয়ে বসল শঙ্খদা। তারপর বলতে শুরু করল।
‘চার্নক সাহেব কলকাতায় আসার আগেও যে এই কলকাতা ছিল, তার প্রমাণ আছে গুরু নানকের জীবনীতেই। গুরুমুখি ভাষায় লেখা সেই জীবনীতে পরিষ্কার বলা আছে, ১৫০৩ সালে গুরু নানক কলকাতায় এসেছিলেন।’
‘তুমি গুরুমুখী ভাষাও জানো?’ পিকাই জিজ্ঞাসা করল।
প্রশ্নটাকে ততটা পাত্তা না দিয়ে শঙ্খদা বলে চলল ‘গুরু নানক যেখানে বসে ধর্মপ্রচার করেছিলেন এবং বিশ্রাম নিয়েছিলেন, সেই জায়গাটা কালক্রমে এক জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৬৬৬ সালেশিখেদের নবম গুরু, গুরু তেগবাহাদুর সেই জায়গাখানা তৎকালীন জমিদারের থেকে কিনে নেয়। তারপর সেখানে তিনি বড়া শিখ সঙ্গত গুরুদ্বারা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’
‘আরিব্বাস! এটা এখনও আছে?’
‘থাকবে না কেন। এম. জি. রোড আর চিৎপুর রোডের মোড়ের কাছে চলে যা। ওখানে যে গুরুদ্বারাটা আছে, সেটার কথাই বলছি।’
‘কলকাতায় গুরু নানক! ভাবতে পারছিস?’ বল্টু আর পিকাই নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করতে লাগল।
‘আরও আছে,’ বলে শঙ্খদা আবার বলতে লাগল, ‘শোনা যায়, একসময় কলকাতা নদীয়া জেলার অংশ ছিল। অত্যন্ত জলা জায়গা ছিল এটা। সেই জলাজমির গ্রামে কয়েকঘর চাষি আর জেলে বাস করত। ১৬৯০ সালে জোব চার্নক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপন করার সনদ পান। তারপর ১৬৯৮ সালে আওরংজেবের নাতি আজিম-উন-শাহে থেকে তিনটি গ্রাম কেনার অনুমতি নেন। তার রেঞ্জের গল্প তো আগেই বলেছি। মনে আছে তো?’
‘গুড। মোটামুটি পনেরোশ’ শতক থেকে কলকাতার উল্লেখ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া গেলেও তারও আগে কলকাতার নামের উল্লেখ আছে। তাও আবার লিটারেচারে।’
‘চাঁদ সদাগরের নাম শুনেছিস?’
‘ওই বেহুলা-লখিন্দরের গপ্পো তো? মনসামঙ্গল?’
‘বিপ্রদাস পিপলাই। অবশ্য একা ইনিই রচনাকার নন। অনেকেই মনসামঙ্গল লিখেছিলেন। তবে তার মধ্যে কানা হরিদাস, বিজয়গুপ্ত, নারায়ণদেব, আর বিপ্রদাস পিপলাই-ই সবচেয়ে ফেমাস। একেকজনের ভার্সন একেকরকম, নানারকম লেখার স্টাইল। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল লেখা হয় ১৪৯৫ সালে। একমাত্র এই মনসামঙ্গলেই সন-তারিখের একটা ঠিকঠাক হিসেব পাওয়া যায়। সেখানে চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যযাত্রা বর্ণনায় কলকাতা কেন, কলকাতার আশেপাশের অনেক জায়গার নামই সেখানে আছে। দাঁড়া, বইখানার কপি বের করি।’
ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে কী যেন খুটখাট করে শঙ্খদা একটা পিডিএফ বের করে ফেলল। তারপর পড়তে লাগল:
ডাহিনে হুগলি রহে বামে ভাটপাড়া
পশ্চিমে বাহিল বোয়ো পূর্বে কাঁকিনাড়া।
মূলাজোড় গাড়ুলিয়া বাহিল সত্ত্বর
পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর।
চাঁপদানি ডাহিনে বামেতে ইছাপুর
বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর।
বামে বাঁকিবাজার বাহিয়া যার রঙ্গে
জমিন বাহিয়া রাজা প্রবেশে দিগঙ্গে।
পূজিল নিমাইতীর্থ করিয়া উত্তম
নিমগাছে দেখে জবা অতি অনুপম।
চানক বাহিয়া যায় বুড়নিয়ার দেশ
তাহার মেলান বাহে আকনা মাহেশ।
খড়দহে শ্রীপাট করিয়া দণ্ডবত
বাহ বাহ বলি রাজা ডাকে অবিরত।
রিসিড়া ডাহিনে বাহে বামে সুকচর
পশ্চিমে হরিষে রাজা বাহে কোননগর।
ডাহিনে কোতরং বাহে কামারহাটী বামে
পূর্বেতে আঁড়িয়াদহ ঘুসুড়ি পশ্চিমে।
চিতপুরে পূজা রাজা সর্বমঙ্গলা
নিশিদিসি বাহে ডিঙ্গা নাহি করে হেলা।
পূর্বকূল বাহিয়া এড়ায় কলিকাতা
বেতড়ে চাপায় ডিঙ্গা চাঁদো মহারথা।
‘কী বুঝলি?’ পড়া শেষ হতে শঙ্খদা প্রশ্ন করে।
‘উরি বাপ রে বাপ রে বাপ! এ সব নামই তো চেনা!’
আধবোজা চোখে মাথাটা একটু নাড়িয়ে শঙ্খদা বলল, ‘হুঁ হু! বলেছিলাম। যাই হোক, লিটারেচারের কথা যখন উঠলই, তাহলে আরও কয়েকটার কথা বলতে হয়।